পরাধীন ভারতে স্বপ্নের দেশের মানচিত্র একেছিলেন অকাল প্রয়াত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। তার ‘দুর্মর’ কবিতার শুরু এভাবেই,
‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলা দেশ
কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে,
সে কোলাহলে রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ
জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।
কিন্তু উপনোবেশিক শাসকগোষ্ঠী তা মানেনি। লুটেরারা লুট করেছে ইচ্ছে মতো। কেড়ে নিয়েছে বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু ধর্মের অনন্য সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের মৈত্রী। সীমিত দৃষ্টিশক্তির কারণে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যাওয়া হয়নি সিরিল রেডফ্লিকের। তার নেতৃত্বের সীমানা কমিশন দায়িত্ব পায় ভারত ভাগের। টুকরো টুকরো করে বিভক্ত করা হয় মহাভারতকে। সুবিধাবাদী ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা মেনে নেয়। যে ব্যাথায় এখনও কাঁদে বাংলা। কাঁদে পাঞ্জাব। আরও কত যৌথ সংস্কৃতির জনপদ।
ভাগ ও শোষণের এ কৌশল শাসককূল রপ্ত করেছে বহু আগেই। আজাদি ঝুটা হয়। প্রতিরোধের রাজনীতিও সফলতা পায় না। সাধারণ মানতে বাধ্য হয় সীমানা প্রাচীর। সহস্র বছর ভাই বোন হয়ে থাকা দেশগুচ্ছের এখনের বিবাদে মজা লুটে যায় দূর থেকে ক্রীড়ানকরা। কবি সুকান্তের মানচিত্র তার মতোই প্রয়াত হয় অকালে। ভাগ হয় নদী, সমুদ্র, পাহাড়, বনসহ পুরো জমিন।
আরও অনেক কিছুর মতো বিভক্ত হয় বিরল ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন। উইকিপিডিয়ার তথ্যমাফিক ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার থাকে বাংলাদেশে। বাকি অংশ পায় ভারত। বিষ্ময়কর এ বন ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। আজকের এই ১৪ ফেব্রুয়ারি এই বাদাবনকে সংরক্ষণেরই তাগিদ দেয়া এক দিন। ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় সুন্দরবন দিবস। নাগরিক ফাল্গুনবরণ ও ভালোবাসা দিবসের আড়ালে যে দিনটির খোঁজ রাখেন না অনেকেই।
সংবাদমাধ্যম মাফিক জানা যায়, ২০০১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘রূপান্তর’ ও ‘পরশ’ এর সক্রিয়তায় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের ঘোষণায় দেশের আরও ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের অংশগ্রহণে প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘সুন্দরবন দিবস’ পালিত হয়ে আসছে।
বার বার ধেয়ে আসা সিডর, আইলা মতো সাইক্লোন ঠেকানো পরিক্ষিত এ বন উজাড় হয় দিনে দিনে। একে ঘিরে এখন কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অগণন শিল্প কারখানা। শুধু বিরক্ত না করলেই টিকতো সুন্দরবন – এ উচ্চারণ শোনেনি কেউ। তাই চিরহরিৎ বিলীন হয়। ভারসাম্য হারায় বনের জীববৈচিত্র। বিলুপ্তির পথে দেশের সমার্থক বাঘ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। যদিও শুধু ক্রিকেট মাঠেই ‘টিম টাইগার’ ধ্বনী শোনা যায় অহর্নিষ। বনে বাঘের প্রকৃত সংখ্যা আর তার নিরাপদ বাস্তুসংস্থানের গর্জন চাপা পড়ে যায় নব্য মাঠে নামাদের বিজ্ঞাপনে।
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি সেই শক্তিমত্তার বাঘের আবাস সুন্দরবনকে বাঁচানোর ডাক দেয়ার একদিন। দেশের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে বন। ত্রাণকর্তা হয়ে যে ম্যানগ্রোভ বাঁচায় সবুজ ব-দ্বীপকে। যার প্রাণ, প্রকৃতি, বনের বাওয়ালের শেষ নি:শ্বাস এখন প্রতি মুহূর্তে। কিভাবে এড়াতে পারি এই মমতাময়ীর বাঁচার আকুতি? বিশ্বায়িত পৃথিবীর তো জানা হয়ে গেছে এক নবীন কবির উচ্চারণ ‘তুমি আর আমি মূলত সবুজ। আর আমরা কেবল লুকোতে পারি অরণ্যে…’
হাসান শাওন, লেখক, সাংবাদিক