প্রফেসর ড. এম. শাহ্ নওয়াজ আলি: গণতন্ত্র, ন্যায্যতা, সাম্য ও মানবিক রাষ্ট্র বা সমাজ আমাদের প্রাণের দাবি। কেউ কখনো কোনোদিন আমাদের ন্যায্য দাবি সহজে মেনে নিত না। বরং প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করত সবসময়। সব কালে, সব শাসকেরাই এমন অন্যায্য আচরণ করত। এককালে ব্রিটিশরা আমাদের শাসন করে গেছে। আমাদের বঞ্চিত করে সব লুটেপুটে খেয়ে গেছে। আমরা জানতাম না, বুঝতাম না ভেবে যা মনে হয়েছে করেছিল তারা। বাঙালি হয়তো একসময় শিক্ষা-দীক্ষায় অন্যদের টেক্কা দেওয়ার অবস্থানে ছিল না, তাই বলে মেধা-মননে পিছিয়ে ছিল? কখনোই না।
আমাদের আসলে কেউ সুযোগই দিত না। ব্রিটিশদের বিদায়ে স্বস্তির জীবনের আশা ছিল, তা হতাশায় পর্যদুস্ত হলো। পাকিস্তানিদের সঙ্গে সঙ্গে ভাই ভাই হিসেবে বাঁচার ইচ্ছে বাঙালির ছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের মতো পাকিস্তানি শাসকেরাও আমাদের স্বস্তি দেয়নি। শান্তি, প্রগতি, ন্যায্যতা ও মানবিকতায় বিশ্বাসী বাঙালি অনাকাক্সিক্ষত বঞ্চনা যেন বিতারণ করতে পারছিল না কোনোভাবেই। কারও সঙ্গেই বাঙালি বিবাদে জড়াতে চায় না, শান্তি যেখানে যাদের সর্বদা প্রত্যাশিত সেখানে অশান্তি তো প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু পাকিস্তানিরা আমাদের অশান্তির চূড়ান্তে তুলে দিলে প্রতিরোধের বিকল্পও ছিল না। শোষকেরা বাঙালির প্রতিরোধে মুখ থুবড়ে পড়ল। জয় এলো হাজারও বঞ্চনার শিকার বাঙালির।
স্বাধীনতা পেলাম আমরা। কিন্তু স্বাধীনতার মহানায়ককেও হারালাম। দুষ্কৃতিকারী, ঘাতকেরা বাঙালিকে পিছিয়ে দিতে জনককে হত্যা করল সপরিবারে। ভেবেছিল দমে যাবে বাঙালি। হয়তো অনেকটা সফলও হয়েছে। অন্তত পঁচাত্তরের পর দীর্ঘ দুই যুগ সামরিক শাসক ও তাদের অনুসারীরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। গণতন্ত্র, উন্নয়ন, সাম্য, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক রাষ্ট্র ওই সময়টাতে অনেকটাই অধরা ছিল। দৃশ্যপট পরিবর্তন হলে, জনককন্যা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। ১৯৯৬-২০০১ প্রথম টার্ম এবং ২০০৯ থেকে ২০১৯ টানা দুই টার্ম দেশ পরিচালনা করছেন শেখ হাসিনা। এই সময়ে দেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক রাষ্ট্রের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হয়েছে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন গবেষকদের মতে, শেখ হাসিনা যখনই রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন, দেশ এগিয়েছে। শুধু কি এগিয়েছে? বাংলাদেশ আসলে তার শাসনামলে আমূল বদলে গেছে। উন্নয়নের বিস্ময় এখন বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয় এখন প্রায় সতেরশ ডলার, মানুষের গড় আয়ু বাহাত্তর, নারী-শিশু, মাতৃমৃত্যু হার এখন নিম্নগামী, শিল্পকারখানা, অবকাঠামো খাতে উন্নয়ন, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের ভয়াল দাবা রুখে দিয়ে এখন বিশ্ব দরবারে সমীহ জাগানিয়া দেশ বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা যেখানে হাত দিয়েছেন, শ্রম দিয়েছেন, সোনা ফলেছে। জনকের সোনার বাংলা এখন অনেকটাই হাতের নাগালে বললে কি ভুল হবে?
এগারো লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে আশ্রিত। বিনা প্রশ্নে, এত মানুষের ভরণপোষণ, নিরাপদে আশ্রয় দেওয়ার সাহস বিশ্বের আর কোন নেতা এর আগে দেখিয়েছেন? জার্মানির এঙ্গেলা মের্কেল হয়তো কিছু শরণার্থী নিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু রাষ্ট্র সামান্য কিছু আশ্রয় প্রার্থীকে ঢুকতে দিয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগ উন্নত রাষ্ট্রই তো তাদের কপাট বন্ধ করে দিয়েছে অসহায়, শরণার্থীদের ঢুকতে দেয়নি। সেখানেই শেখ হাসিনা অনন্য। তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে, বিনা প্রশ্নে আশ্রয় প্রার্থী লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে এদেশের বুকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে। জনককন্যা বলেই সম্ভব হয়েছে এটা।
অনেকের প্রশ্ন, গণতন্ত্র কি এখন সর্বজনীন এখন? সবাই কি গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে পারে? বিশেষ করে বিএনপির রাজনৈতিক দল কেন সভা-সমাবেশ পর্যাপ্ত সুযোগ পায়নি? আমি যদি প্রশ্ন করি, যারা একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াত সঙ্গে নিয়ে এদেশের অস্থিত্ব হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল, যারা সব সময় অন্ধকারের গলি দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসতে চায়, জনগণের শক্তিতে যাদের পূর্ণ বিশ্বাস নেই, তারা কতটা গণতান্ত্রিক? ন্যায্য দাবি থাকলে সেটা আদায়ে লড়াই করতে হয়। ন্যায্য দাবিতে কেউ বাধা দিয়ে আটকাতে পারেনি কখনো। বিএনপির সেই নৈতিক শক্তি কি আছে? থাকলে আসলে তাদের আজকের অবস্থান হতো না। জনগণের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে কেউ ঠকাতে পারে না। সেই জায়গায় বিএনপির ঘাটতি আছে। তার ফলেই বিএনপি আজকে এই পিছিয়ে পড়াদের দলে।
ষড়যন্ত্র আর বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেই শেখ হাসিনা এগোচ্ছেন বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে। সেখানে তার কাছে প্রতিকূলতা তুচ্ছ। তিনি ছুটে চলছেন দুর্দমনীয় গতিতে, বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে। ক্লান্তিহীন, কঠোরশ্রমী শেখ হাসিনার এই ছুটে চলা যতদিন থাকবে, বাংলাদেশকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না।
লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন