শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সর্বগ্রাসী করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)বৈশ্বিক মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ায় গোটা বিশ্বে ঘটেছে বড় ধরনের ছন্দপতন। ব্যাপক ক্ষতির মুখে ব্যবসা-বাণিজ্য। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী পর্যটন খাতে দেখা দিয়েছে অশনি সংকত। বিশ্বের ২১৩টি দেশের মধ্যে করোনা তাণ্ডবের মধ্যে কিছু কিছু দেশ করোনা জয়ে গল্প বলছে; কিছু দেশ করোনা মোকাবিলা ও আতঙ্কে কঠিন সময় পার করছে। যদিও বিশ্ব স্বাস্খ্য সংস্থা বলছে, এই করোনা অতি সহজেই বিদায় নিচ্ছে না। করোনা মহামারির প্রাথমিক স্তরে রয়েছে বলে জানিয়ে সংস্থাটি। আরও করোনা তাণ্ডবের আরও ভয়ঙ্কর পরিস্খিতি বিশ্বকে দেখতে হতে পারে। তবে এর মধ্যেই বিশ্ব মানবতার জীবনমান ও অর্থনীতিতে ব্যাপক ধস নেমে এসেছে। এছাড়া করোনাভাইরাস মহামারি পরবর্তী বিশ্বে অর্থনীতির অবস্থা কী দাঁড়াবে, সেটা নিয়েও সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় অর্থনীতি গবেষণকরা। অনেকের ধারণা, মহামারি হয়তো নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে, কিন্তু এটা করতে গিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির যে মারাত্মক ক্ষতি এর মধ্যে হয়ে গেছে, তা কাটাতে বহু বছর লেগে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউন থাকুক বা উঠে যাক, আমরা যেভাবে চলি, শপিং করি, খেতে যাই, বেড়াতে যাই, কাজ করি, পড়াশোনা করি- এই সমস্ত কিছুই আমূল বদলে দিতে যাচ্ছে করোনাভাইরাস।
কিছু পরিবর্তন এরই মধ্যে ঘটে গেছে। বিশ্বের বহু মানুষ এখন ঘরে বসেই কাজ করছেন। প্রযুক্তি খুব সহজ করে দিয়েছে ব্যাপারটি। অনেক স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পাঠদান করছে অনলাইনে।
করোনাভাইরাসে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ একটি খাত হচ্ছে বিমান চলাচল এবং পর্যটন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হলে এবং করোনাভাইরাসের টিকা আবিস্কার বিলম্বিত হলে, এই দুটি খাতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। তার মানে কাজ বা বিনোদনের জন্য যে ধরণের বাধাবিঘ্নহীন ভ্রমণে এখন মানুষ অভ্যস্ত তা অনেক পাল্টে গেছে ভবিষ্যতে আরও পাল্টে যাবে। বিশেষ করে বিমান ভ্রমণ অনেক ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়াবে। ফলে যাত্রী সাধারণ বিমান ভ্রমণে আগ্রহ হারাবেন। ফলে আন্তর্জাতিক পর্যটন ব্যবসায় ধস নামার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ডেভিড প্যাসিগ হচ্ছেন একজন ফিউচারোলজিস্ট। তিনি ইসরায়েলের বার ইলান ইউনিভার্সিটির ‘স্কুল অব এডুকেশনের’ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ল্যাবের প্র্রধান। ডেভিড প্যাসিগ মনে করেন, করোনাভাইরাস মহামারি কতদিন চলে, সেটার ওপর নির্ভর করবে এসব পরিবর্তন কত দীর্ঘস্থায়ী হয়। জেরুসালেম পোস্ট পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এক্ষেত্রে তিন ধরণের অবস্থা হতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি। প্রথম পরিস্থিতে, যেটার সম্ভাবনাই বেশি বলে তার ধারণা, এক বা দুই বছরের মধ্যে এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তবে মহামারিতে বিশ্বজুড়ে মারা যাবে প্রায় দশ লাখ মানুষ। এক্ষেত্রে মানুষ দ্রুতই এই মহামারির বিভীষিকা ভুলে যাবে এবং দ্রুত তাদের পুরোনো অভ্যাস বা রীতিতে ফিরে যাবে।
কিন্তু দ্বিতীয় দৃশ্যকল্প, যেখানে মহামারি স্থায়ী হবে প্রায় পাঁচ বছর এবং মারা যাবে প্রায় দশ কোটি মানুষ, সেটির ধাক্কা সামলাতে লাগবে আরও পাঁচ বছর। এরকম পরিস্থিতিকে ডেভিড প্যাসিগ বর্ণনা করছেন ‘সম্ভাব্য পরিস্থিতি’ বলে, তার অর্থনৈতিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা অনেক কঠিন হবে। তা সত্ত্বেও একটা সময়ের পর মানুষ তার স্বাভাবিক আচরণে ফিরে যাবে, যেমনটি ঘটেছিল স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির পর।
ডেভিড প্যাসিগের তৃতীয় দৃশ্যকল্পটি সবচেয়ে ভয়ংকর। তার মতে এটি হচ্ছে ‘ওয়াইল্ড কার্ড সিনারিও’, অর্থাৎ এর সম্ভাবনা খুবই কম। এক্ষেত্রে মহামারি দশ বছরের বেশি স্থায়ী হবে এবং দশ কোটি হতে তিরিশ কোটি মানুষ এতে মারা যাবে। তাঁর মতে, এরকম ক্ষেত্রে মানুষের আচরণে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন ঘটবে।
মানুষে-মানুষে সংস্পর্শ কমে যাবে এবং অন্যের সংস্পর্শে আসার ক্ষেত্রে মানুষের মনে যে ভয় সেঁটে গিয়েছে, তা কাটাতে দশ হতে বিশ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যাবে। আর মানুষের এই আচরণের কারণে নতুন ধরণের সেবা, শিল্প, বিজ্ঞান থেকে শুরু করে অনেক কিছু গড়ে উঠবে। করোনা তাণ্ডবের এই ভয়ঙ্কর খেলার মধ্যেও বিশ্বের বুকে মানুষ করোনা জয়ে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কারণ- মানুষই তো এই অচেনা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছিলো। আজ অদৃশ্য শত্রু করোনায় পরাস্থ হতে পারে না বিশ্ব। করোনা জয় করে বিশ্ববাসী আগের মতো ধরণীর বুকে ছুঁটে চলবে স্বাভাবিক গতিতে; এই হোক আজকের প্রত্যাশা।